মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১১

দ্বিতীয় পৃথিবীর খোঁজ

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী

দ্বিতীয় পৃথিবীর খোঁজ

ডিসেম্বর ১৩, ২০১১
farseem-f11121111121111ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন আটলান্টিক মহাসাগর ডিঙ্গিয়ে নতুন অভিযানের কল্পনা করছিলেন, তখন কেমন ছিল তার মনোভাব? কিংবা ১৪৯২ সালের ১২ই অক্টোবর ভোর দুটোয় যখন ‘পিন্টা’ জাহাজের মাস্তুল থেকে চিৎকার ভেসে এল দূর ডাঙ্গার খবর, আর ‘পিন্টা’র কাপ্তান সেটা যখন কামান দেগে কলম্বাসকে জানালেন, তখন কলম্বাস কী ভাবছিলেন? তিনি কি ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলেন, অই নতুন জমির খোঁজ তার চেনা-জানা ইউরোপকে কীভাবে বদলে দেবে? কলম্বাস যখন নতুন দেশ জয়ের আকাঙ্খা দেখছিলেন তখন তিনি কি এর ঐতিহাসিক ফলাফলের কথা বিবেচনা করতে পেরেছিলেন? নতুন মহাদেশের আবিষ্কার ইউরোপে নতুন পুঁজির সৃষ্টি করে, নতুন প্রণোদনা জোগায়, এমনকি শিল্পবিপ্লবের বীজ বপন করে। ঢালাও শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বৃহৎ পুঁজি যোগান দিয়েছিল অই নতুন মহাদেশটির ধন-রত্ন। ঠিক একই রকম রোমাঞ্চ গ্যালিলেও অনুভব করেছিলেন যখন তিনি টেলিস্কোপে চোখ রেখে দূর গ্রহসমূহ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি দেখেছিলেন বৃহস্পতির সুন্দর চারটি মুক্তোর দানার মতো জ্বলজ্বলে উপগ্রহগুলি। তিনি তখন কেমন অনুভব করেছিলেন? কিংবা ধরা যাক, কেপলার নভোবীক্ষণ যন্ত্রের জটিল আলোকরেখার দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর মতো গ্রহের উপস্থিতির চিহ্ন আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের মনেই-বা কী প্রতিক্রিয়া জাগিয়েছে? অথবা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনের অবস্থাই-বা কী? সুদূরতমার এই গহন ডাক মানুষকে কীসের হাতছানি দেয়?
এই বিরাট বিপুল মহাবিশ্বে কি আর কোথাও আমাদের আরেকটি দ্বিতীয় বাসস্থান নেই – যেখানে থাকবে পানি তার তিন দশাতেই (কঠিন-তরল-বায়বীয়), থাকবে সহনীয় তাপমাত্রা (না খুব বেশী, না খুব কম), থাকবে বায়ুমণ্ডল, থাকবে টেকটনিক সক্রিয়তা ইত্যাদি? যা কিছু আমরা এই অতিপ্রিয় পৃথিবীতে দেখি, ঠিকঠিক সেইরকম একটা দ্বিতীয় পৃথিবীর খোঁজ মানুষের বহুদিনের। এ যেন সেই এলডোরাদোর মতো অলৌকিক নগরীর খোঁজ যেখানে আছে কেবল সম্পদ আর সম্পদ! এমন এক নতুন পৃথিবীর সন্ধান যেন আমাদের সবকিছু নতুন করে শুরু করার এক পরাবাস্তব স্বপ্নের হাতছানির মত! দ্বিতীয় ইউটোপিয়া রচনার সাধ যেন-বা!
অতি সম্প্রতি মনে হয় ঠিক এরকম একটা পৃথিবীর খোঁজ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। নতুন এই গ্রহটির নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন কেপলার-২২বি। এটি আমাদের পৃথিবীর চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ ভারী, এবং এটি এর নক্ষত্র থেকে এমন দূরত্বে থাকে যাতে এখানে তরল পানির অস্তিত্ব থাকতে পারে। এ ধরনের অঞ্চলকে বলে হ্যাবিটেবল জোন বা বাসযোগ্য অঞ্চল, অর্থাৎ এটি এমন এক অঞ্চল যেখানে প্রাণের উপযোগী সকল ভৌত শর্তাবলি উপস্থিত থাকে। সূর্যের জন্য এই অঞ্চলের মান ০.৬৩ থেকে ১.১৫ জ্যোতির্বিদ্যার একক দূরত্বে অবস্থিত, যেখানে এক জ্যোতির্বিদ্যার একক হল সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের সমান। এই মানটি অবশ্য নক্ষত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়, এর মূলসূত্রটি হল এরকম যে এটা সেই দূরত্ব নির্দেশ করে যে দূরত্বে অবস্থান করলে গ্রহের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা শূন্য থেকে একশত ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। কেপলার-২২বি গ্রহটি পৃথিবীর ২.৪ গুণ বড়, এটি যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে তার আয়তন আমাদের সূর্যের তুলনায় সামান্য ছোট। তাই কেপলার-২২বি’র কক্ষপথও পৃথিবীর তুলনায় সামান্য ছোট এবং তার সূর্যকে একবার ঘুরে আসতে কেপলার-২২বি’র সময় লাগে ২৮৯ দিন। এই তারাটির বর্ণালি সূর্যের মতোই জি-টাইপ হলেও এর তাপমাত্রা কিছুটা কম এবং এর দূরত্ব ৬০০ আলোকবর্ষ। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এখনো বলতে পারছেন না যে গ্রহটির অভ্যন্তরভাগ পাথুরে না গ্যাসীয়। দ্বিতীয় পৃথিবীর এই সন্ধান মানুষকে সত্যিই এক আলাদা দিগন্ত দেয়, মনে হয় যেন আরেক পৃথিবীতে আমরা স্বপ্নের এক আশ্চর্য জগৎ তৈরি করে নেব। যদিও স্বপ্ন আর বাস্তবতার ফারাক বিশাল – বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে ৬০০ আলোকবর্ষ দূরত্ব একজন মানুষের কেন তার ছয় প্রজন্মের জীবদ্দশায়ও পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়! কিন্তু তারপরও মানুষের দিগন্ত কিন্তু প্রসারিত হয়ে যায় শুধু এই তথ্যে। নাই বা পারলাম যেতে। কিন্তু আছে তো!
ন্যাসা কর্তৃক ৭ মার্চ ২০০৯ সালে কেপলার মিশন উৎক্ষিপ্ত হয়, মিশনের আয়ুষ্কাল ৩.৫ বছর, এবং এর প্রধান লক্ষ্য পৃথিবীর মত দেখতে গ্রহদের খুঁজে বের করা যারা তাদের নিজেদের নক্ষত্রের চারিদিকে অবস্থিত বাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে থাকে। এই কাজে দূরবর্তী নক্ষত্রের আলোর অতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন পরিমাপ করে গ্রহের আকৃতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করা হয়। গ্রহ যখন তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যাবে তখন নক্ষত্রের আলোর সামান্য পরিবর্তন ঘটবে, কিংবা গ্রহের মহাকর্ষীয় টানাপোড়নের ফলে নক্ষত্রের গতি অতি সামান্য টাল খায় – এইসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাপ থেকে দূরান্তের গ্রহের প্রকৃতি নির্ণয় করা হয়। কেপলার মিশনে একটি হাইপার-সেন্সিটিভ ফটোমিটার রাখা আছে যার উদ্দেশ্য নক্ষত্রের আলোর সামান্য তারতম্য পরিমাপ করা। এ পর্যন্ত (ডিসেম্বর ২০১১) কেপলার মিশন কয়েক হাজার গ্রহ-প্রার্থী খুঁজে পেয়েছে যাদের মধ্যে প্রায় ২০০টির মতো গ্রহ পৃথিবীর মতোন, তাদের মধ্যে ৪৮টি আছে বাসযোগ্য অঞ্চলের ভেতরে। এখন এই মিশনের কাজ হলো ঐসব গ্রহকে আরো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আরো পৃথিবীর ‘হৃদয়ের বোন’দের খুঁজে ফেরা।
মহাবিশ্বে ধীমান সত্তার খোঁজ নতুন কিছু নয়। ১৯৬০-এর দশক থেকে রেডিও জ্যোতির্বিদরা চরাচর চষে ফিরছেন এলিয়েনদের খোঁজে। কোথায় তারা? এই বিষয়ে ফ্র্যাঙ্ক ড্রেকের একটি বিখ্যাত সমীকরণ আছে যা কোনো একটি গ্যালাক্সিতে বুদ্ধিমান সত্তার সম্ভাব্য সংখ্যার একটা গাণিতিক হিসাব দেয়। এই বিষয়ে আমি আগের একটি লেখায় বিশদ বলেছি। ড্রেকের সমীকরণ ব্যবহার করে আমাদের গ্যালাক্সিতে সম্ভাব্য সভ্যতার সংখ্যা ড্রেক নিজে পেয়েছিলেন ১০,০০০। অবশ্য অনেকেই এই সংখ্যাকে আরো অনেক কম মনে করেন। কিন্তু তারপরও এই সংখ্যাটিকে একটি শুরুর বিন্দু বা প্রাথমিক হিসাব হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও মনে হতে পারে, ৬০০ আলোকবর্ষ যেতেই তো আমাদের কয়েকডজন প্রজন্ম পার হয়ে যাবে, তো এই দূরাগত প্রায়-অসম্ভব ইউটোপিয়ার কথা ভেবে লাভ কী? কাছের মঙ্গলেই তো আমরা এখনো মানুষ পাঠাতে পারিনি। এর কোনো জবাব নেই, কিন্তু ভাবুন যে কলম্বাস যখন আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেছিলেন তখন তার স্বপ্ন-কল্পনা কতই না সামান্য ছিল, কিন্তু সেই আবিষ্কারের ফলাফল ইউরোপ কতদিন ধরে ভোগ করেছে এবং করে আসছে!
কেন আমরা দ্বিতীয় পৃথিবীর খোঁজ করব, যখন আমাদের পৃথিবীতেই দারিদ্র্যকে এখনো মিউজিয়ামে রাখা যায়নি? বিজ্ঞানী হয়ত বলবেন যে, পৃথিবীতেই আমাদের এই বুদ্ধিমান সভ্যতাটিকে বেঁধে রাখার কোনো কারণ নেই। আন্তঃনাক্ষত্রিক স্পেসে এই সভ্যতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে, আমাদের সূর্য যখন তার অন্তিম দশায় ফুলে-ফেঁপে উঠবে তখন এই পৃথিবীকে ছাড়তেই হবে। তখন যাব কোথায়? এখনই যদি না খুঁজি, তবে তখন কী হবে? দূরত্ব পেরনোর প্রযুক্তিই বা পাব কী করে, যদি এখনই গবেষণা না শুরু করি? মানছি, সূর্যের ঐ পর্যায়ে যেতে সময় লাগবে ৫০০ কোটি বছর, কিন্তু স্বপ্ন যদি এখনই না দেখি, তবে? আমাদের জনসংখ্যা যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে গ্রহান্তরে পাড়ি দেবার প্রয়োজনীয়তা আর সূর্যের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত বসে থাকার দরকার হবে না। আমি বাজি ধরতে রাজি আছি, বর্তমান প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী দুশো বছরের মধ্যেই আমরা ইন্টারস্টেলার ভ্রমণ করতে সক্ষম হব। একইরকম মনোভাব প্রফেসর স্টিফেন হকিংও ব্যাক্ত করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক ডিভিডি সিরিজে (ইনটু দ্য ইউনিভার্স)। লম্বা জার্নির প্রধান অন্তরায় হল আমাদের মানুষী আয়ু, কবির কাছে যেমন মনে হয়েছিল ‘পদ্মপত্রে নীর’। কিন্তু ইদানিংকালের গবেষণায় আয়ুকে প্রলম্বিত করার বেশ আশাবাদী কিছু বৈজ্ঞানিক ফলাফল আমরা জানতে পেরেছি। এরকমটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আর ভয় কি, আসুন আমাদের বসন্তকালীন নিবাস হিসেবে আমরা কেপলার-২২বি’কে বেছে নেই। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরাও ভেবে দেখতে পারেন! বাক্স-পেটরা গুছিয়ে রাখাই ভালো, কখন ডাক পড়ে!
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী : বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
তথ্যসূত্রঃ
১/ তরুন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী খান মুহম্মদের অদ্ভুত সুন্দর ভিডিও ব্লগ: http://www.youtube.com/watch?v=znTfTbkySBY।
২/ ‘দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধানে’, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, ফেসবুক নোট, ৬ই ডিসেম্বর ২০১১।
৩/ ‘সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা’, সৈয়দা লাম্‌মীম আহাদ ও ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, প্রকাশিতব্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন